পৃথিবী যেন এখন এক বিষাক্ত নিঃশ্বাসে হাঁপিয়ে ওঠা গ্রহ। ঘন বাতাসে বিষ, নদীর জলে বিষাক্ততা, আর বনভূমি স্মৃতি হয়ে পড়ছে মানচিত্রে। বছরের পর বছর পরিবেশ দিবস আসে, কিছু আলোচনা হয়, কিছু অঙ্গীকার লেখা হয় ফেসবুক স্ট্যাটাসে কিন্তু পরিবেশের ক্ষত যেন আরও গভীর হয়েই চলে। ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস, আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই পৃথিবী একটাই, আর এই পৃথিবীকে বাঁচানো আমাদের সবার দায়িত্ব। এ বছরের প্রতিপাদ্য “Ending Plastic Pollution”। প্লাস্টিক একদিকে আধুনিক জীবনের অংশ, অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় দায়ী। এই সংকট মোকাবেলায় তরুণরা কী ভাবছে? দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাবনা, উদ্বেগ এবং পরিবর্তনের ডাকের কণ্ঠ তুলে ধরেছেন আবু হুরায়রা।
“প্রতিদিনের অভ্যাসেই গড়ে উঠুক পরিবেশ সচেতনতা”
কানিজ বাতুল মায়িশা
১ম বর্ষ, ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।
পরিবেশ বিপর্যয় এখন আর দূরের কোনো বিপদ নয় এটি বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন সংকটগুলোর একটি। জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, পানি ও বায়ু দূষণ, জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি সবকিছু আমাদের ভবিষ্যৎকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, পরিবর্তন সম্ভব যদি তা শুরু হয় সচেতনতা থেকে, আর প্রতিদিনের ছোট ছোট অভ্যাস থেকে। পরিবেশ দিবস শুধু একটি প্রতীকী দিন নয়, এটি হতে পারে আমাদের প্রতিদিনের দায়িত্বের প্রতিচ্ছবি। প্লাস্টিক কমানো, পানি ও বিদ্যুৎ অপচয় রোধ, গাছ লাগানো কিংবা নিজের চারপাশ পরিষ্কার রাখার অভ্যাস এসবই পরিবেশবান্ধব সমাজ গঠনের ভিত্তি হতে পারে। আমাদের পরিবেশ-সচেতনতা বক্তৃতা বা ফেসবুক স্ট্যাটাসে নয়, প্রতিদিনের কাজে প্রকাশ পেলেই তা হবে অর্থবহ। তরুণদের এখনই এগিয়ে আসতে হবে। পরিবর্তনের শুরু হোক নিজ থেকে, আজ থেকেই।
“নির্মল পরিবেশের জন্য দরকার সম্মিলিত সচেতনতা ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা”
আবু উবাইদা
৩য় বর্ষ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
পরিবেশ শুধু গাছ-পালা বা নদী-নালা নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি। অথচ আমরা নিজেরাই তা ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছি অসচেতনতা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে। এই অবস্থা থেকে বের হতে হলে শুধু উদ্বেগ প্রকাশে হবে না, চাই কঠোর ও বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা। সরকারকে পরিবেশ রক্ষায় দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে, এবং তার বাস্তবায়নেও থাকতে হবে আন্তরিকতা। পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন করতে হবে চাহিদা ও সুবিধার বাইরে গিয়ে। আমরা যদি ময়লা ফেলার অভ্যাস বদলাই, কলকারখানার বর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্কাশন করি, বৃক্ষরোপণ ও বন সংরক্ষণে সক্রিয় হই, তাহলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দেওয়া সম্ভব।
“সবুজ পৃথিবী বইয়ে, বিষাক্ত বাস্তবতা চারপাশে”
পিয়া খানম
৩য় বর্ষ, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বইয়ের পাতায় এখনো সবুজ বনভূমি, স্বচ্ছ নদী আর নির্মল আকাশের ছবি আঁকা হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। গ্রীষ্মে খরা, বর্ষায় বন্যা, বিষাক্ত বাতাস আর দখলদারিত্বে মৃতপ্রায় নদীগুলো যেন প্রকৃতির ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ। উন্নয়নের নামে বন উজাড়, নদী দখল, প্লাস্টিকের বর্জ্যে শহর ভরিয়ে দেওয়াই আজকের উন্নয়ন চিত্র। এই অবস্থার প্রভাবে শুধু পরিবেশ নয়, খাদ্য নিরাপত্তা ও মানুষের জীবনযাত্রাও হুমকির মুখে। তবু আমরা তরুণরা আশা হারাইনি। আমরা বিশ্বাস করি পরিবর্তন সম্ভব, যদি তা আসে যৌথ উদ্যোগে। পরিবেশবান্ধব জীবনধারা, এবং প্রকৃতির প্রতি সম্মান ও দায়িত্ববোধ নিয়ে যদি আমরা এগিয়ে যাই তবে এই বিষাক্ত বাস্তবতাকে বদলে দেওয়া অসম্ভব নয়।
“প্লাস্টিক দূষণ কেবল সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সংকট”
শেখ নূর রহমান
২য় বর্ষ, ফার্মেসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
এই বছরের পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য “Ending Plastic Pollution” এখনকার বাস্তবতায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্লাস্টিক আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এতটাই ঢুকে পড়েছে যে, তা ছাড়া জীবন কল্পনাও কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ এই প্লাস্টিকই পরিবেশের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির প্রধান উৎস। এটি শত শত বছরেও মাটিতে মিশে না, জলজপ্রাণী ধ্বংস করে, এবং আমাদের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের মাধ্যমে বিষ ছড়ায়। এই দূষণ বন্ধ করতে হলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতেই হবে। প্লাস্টিক ব্যবহার কমাতে হবে ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে। পুনঃব্যবহারযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার করতে হবে সচেতনভাবে। এই সংকট কেবল একটি সমস্যাই নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের হুমকি আর সেই হুমকি মোকাবেলায় আমাদের হাতে সময় খুবই কম।