গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবদান স্মরণে আলোচনা সভা

চবি প্রতিনিধি
গণঅভ্যুত্থানে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ’ শীর্ষক আলোচনা সভা। ছবি: ক্যাম্পাস রিপোর্ট
গণঅভ্যুত্থানে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ’ শীর্ষক আলোচনা সভা। ছবি: ক্যাম্পাস রিপোর্ট

ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ও জুলুম নিরসনে ফ্যাসিবাদবিরোধী জুলাই বিপ্লবে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অবদান স্মরণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘জুলাই '২৪ গণঅভ্যুত্থানে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ’ শীর্ষক আলোচনা সভা আজ (২৩ জুলাই ২০২৫, বুধবার) সকাল ১০:৩০টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক স্টাডিজ কনফারেন্স রুমে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চবি উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন এবং চবি কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মো. ইকবাল শাহীন খান।

চবি ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. আবু নছর মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠান উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মমতাজ উদ্দীন কাদেরী। অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন উক্ত বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. আহমদ আলী এবং দোয়া ও মুনাজাত পরিচালনা করেন সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ এনামুল হক মুজাদ্দেদী।

প্রধান অতিথির ভাষণে উপাচার্য বলেন, জুলাই বিপ্লবে আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীরা অসামান্য অবদান রেখেছেন। এজন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাদের এ অবদান আমাদের কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে জাতি দেশ গড়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু রাজনৈতিক মতানৈক্য, অনৈক্য, দুর্নীতি ও লুটপাট করে সে সুযোগ আমরা হারিয়েছি। ২০২৪ সালে জাতি আবারও একটি সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছে। এবারের এ সুযোগ যদি জাতি কাজে লাগাতে না পারে, তাহলে জাতির কপালে দুঃখ-দুর্দশা লেগেই থাকবে এবং খেসারত দিতে হবে।

উপাচার্য বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমসহ সকল কার্যক্রমে আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীদের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করে যাচ্ছি। সরকারের প্রতি বেশ কয়েকবার শিক্ষা কমিশন গঠনের দাবি জানালেও সরকার এ পর্যন্ত এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। যেখানে সংস্কার প্রয়োজন হচ্ছে, সেখানেই সংস্কার করছি। আশা করি সরকারও দ্রুত সময়ের মধ্যে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত সংস্কারের আওতায় আনবে।

উপাচার্য আরও বলেন, শরীরের ক্ষত মেরুদণ্ডে, কিন্তু এ ক্ষতের চিকিৎসা না করে আঙুলের চিকিৎসা করে মেরুদণ্ডের ক্ষত শুকাবে না। তেমনি শিক্ষা কমিশন গঠন ছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্য আশা করা অবান্তর।

তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী আমাদের কাছে সমান। ১৯৭১ সালে দেশ গড়ার যে সুযোগ পেয়েছিল, দলের কথা বলে এ সুযোগ নস্যাৎ করা হয়েছে। এ আন্দোলনকে কুক্ষিগত করা যাবে না। সবাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে পরীক্ষার খাতা পুনঃমূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে কাজ করছি। শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালাতেও সংস্কার এনেছি। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কয়েকটি ধাপে পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। যেকোনো ধরনের নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দলকে প্রাধান্য দেওয়া হবে না। আমাদের শিক্ষার্থীরা আমাদের বিরুদ্ধে যত আন্দোলন সংগ্রাম করুক না কেন, তারা আমাদের সন্তানতুল্য। আমরা এগুলো কিছু মনে করছি না। তাদের একাডেমিক তথা সার্বিক উন্নয়নে আমরা তাদের জন্য কাজ করে যাব।

উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) জুলাই গণআন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, আমার শিক্ষাজীবনের স্মরণীয় ঘটনা হলো আওয়ামী প্রশাসনের বিরুদ্ধে লড়তে আমি সিন্ডিকেট নির্বাচন করেছি। সে নির্বাচনে আমি সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছি। তাদের সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি প্রতিবাদ করেছি। উপ-উপাচার্য বলেন, জুলাই বিপ্লবের ফলে ফ্যাসিবাদী সরকার দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। বর্তমান সময়ে আমাদের অনৈক্যের ফলে ফ্যাসিবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে আমাদেরকে অত্যন্ত সাবধান ও হুঁশিয়ার থাকতে হবে।

উপ-উপাচার্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আমরা যেভাবে ঐক্যবদ্ধ থেকেছি, দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে একইভাবে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। কোনোভাবেই ফ্যাসিবাদীদেরকে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনকারীদের দলে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। সংখ্যা কম হলেও ঐক্যবদ্ধ থাকার মাধ্যমে দেশ-জাতির কল্যাণে নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করতে হবে। উপ-উপাচার্য সংস্কারের মাধ্যমে দেশের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে পরবর্তীতে দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে অনুরোধ জানান।

উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) জুলাই বিপ্লবের স্মৃতিকে ধারণ করে চবি ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য আয়োজকদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, জুলাই বিপ্লবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন বর্তমান চবি উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান। তার নেতৃত্বে আমরা শিক্ষকরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করি।

উপ-উপাচার্য বলেন, জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আমরা ফ্যাসিবাদী প্রশাসনের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করি। পরবর্তীতে থানায় গিয়ে বিনা অপরাধে গ্রেপ্তারকৃত আমাদের শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করি। তিনি আরও বলেন, আন্দোলনে আমাদের শিক্ষার্থীদের অবদান অনন্য। তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তাদের একাডেমিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে আমরা কাজ করছি। একইসঙ্গে টিম গঠন করে জুলাই আন্দোলনে শহীদ চবি দুইজন শিক্ষার্থীর পরিবারের খোঁজ-খবর রাখতে প্রশাসনের নির্দেশনা রয়েছে।

উপ-উপাচার্য দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ফ্যাসিবাদী শক্তির সাথে আমরা কখনই আপোষ করতে পারি না। তাদের ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমে আমরা তাদেরকে ঘৃণা করছি। তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ থেকে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। উপ-উপাচার্য জুলাই আন্দোলনে সাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণকারীদের বীর হিসেবে ঘোষণা দেন।

অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রফেসর ড. আ ন ম আব্দুল মাবুদ তাঁর বক্তব্যে জুলাই বিপ্লবে অত্র বিভাগের শিক্ষকদের অবদানের কথা স্মরণ করেন। বিশেষ করে বিভাগের শিক্ষার্থীদের জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।

চবি ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক নিহাদ ও মাকসুদুর রহমান এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পক্ষে স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য রাখেন সমন্বয়ক মুহাম্মদ আলী, সাখাওয়াত হোসেন শিপন, আরিয়ান খান রাখিব এবং রাজবন্দী ও সমন্বয়ক আশিকুর রহমান, আদনান আসিফ শরিফ ও রাজবন্দী মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ।

অনুষ্ঠান শেষে বিভাগের শিক্ষার্থীদের মাঝে দুপুরের খাবার বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে উক্ত বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে জুলাই স্মৃতিচারণ ও সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এতে জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলী, মুজাহিদুল ইসলাম, হাবিবুল্লাহ খালেদ, খাওয়াত হোসাইন, ফজলুল হক শ্রাবন, আরিয়ান খান রাকিব, আব্দুর রহমান, সাইয়েদ তৌহিদুল ইসলাম, আব্দুল্লাহ ফারহান ও রাজবন্দী মো. আলফাজ আহমেদ, মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, আশিকুর রহমান (সমন্বয়ক), আদনান আসিফ শরিফ (সমন্বয়ক) এবং উক্ত বিভাগের শিক্ষার্থী আহত শাহ আলম (আঙুলে ইনজুরি), মাহবুবুর রহমান (আঙুল ইনজুরি), তাফহিমুল ইসলাম (হাতে গুলি), ফয়জুল ইসলাম সোহেল (গুলি), নাছের হোসেন (গুরুতর), শাহাদাত হোসেন রিয়াদ, নিয়ামুল ইসলাম আরহাম, মোস্তফা রহমান (মুখে টিয়ারসেল, পায়ে রাবার বুলেট দ্বারা আহত), মাঈনুদ্দীন হাসান (পিঠে রাবার বুলেট ইনজুরি), রাফসান হামিদ (আহত), মাইনুদ্দিন মুঈনকে (আহত) বিভাগের পক্ষ থেকে উপাচার্য, উপ-উপাচার্যদ্বয় ও অতিথিবৃন্দ সম্মাননা প্রদান করেন।

এছাড়াও অনুষ্ঠানে বিভাগের প্রতি বর্ষের ১ম, ২য় ও ৩য় স্থান অর্জনকারী কৃতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। তাছাড়া পোস্টার প্রেজেন্টেশন পুরস্কার, বুক রিভিউ পুরস্কার, আহত, রাজবন্দী এবং বিভাগের সমন্বয়কদের সম্মাননা ক্রেস্ট, UIHP প্রকল্পে ফলমূল ও শাক-সবজির সংরক্ষণযোগ্যতা (shelf life) বৃদ্ধির উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে ২য় স্থান (৬৫ হাজার টাকা) অধিকার করায় পুরস্কার, ‘বাজার’ ওয়েবসাইট উদ্ভাবনে ৪০ হাজার টাকা অনুদান পাওয়ায় পুরস্কার বিতরণ করা হয়।

সম্পর্কিত